ফল বলতে আমরা নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বককেই বুঝি। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, আনারস, পেঁপে, নারিকেল, লেবু ও কুল এ ১০টি আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত ফল; এগুলোকে আমরা সবাই চিনি। কেননা চোখের সামনে প্রায় সব সময় দেখি, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। অনেকেই হয়তো চিনি আরও কিছু অপ্রধান ও স্বল্পভাবে চাষকৃত ফল যেমন- সফেদা, কামরাঙা, লটকন, বিলাতি আমড়া, বাতাবিলেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, তাল, পেয়ারা এসব ফলকে। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অপ্রচলিত শব্দটির অর্থ হচ্ছে যার প্রচলন নেই অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এগুলো অনেকে বনে জঙ্গলে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে। প্রগতির ধারায় কেউ এগুলো পরিকল্পনায় আনে না। চাষাবাদ দূরে থাক প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও অনেকের ভাগ্যে জোটে না। কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিরামক, ধাতব ও অত্যন্ত প্রাণরাসায়নিক দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না বলে এগুলো অপ্রচলিত।
দেশি ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল এক রকম বিনা যত্নেই এ দেশের মাটিতে ভালো জন্মে। সাধারণত এসব ফলের গাছে তেমন কোনো সার দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড় বাতাস কিংবা বন্যা খরাতেও এ ফলের গাছকে মারতে পারে না। এ ফলের ব্যাপকভাবে খাপখাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা। এ ফলের আর একটা সুবিধা হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফলগাছের মতো এসব ফল বা ফলগাছে অত বেশি রোগপোকারও আক্রমণ হয় না। দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার (বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বারি ও বিনায় দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে কার্যক্রম নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার
১৯৯১ সাল থেকে তরুণ, মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষকদের নিরলস গবেষণার ফলে সর্বমোট ৬৮টি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত বের করা সম্ভব হয়েছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ২১টি, পেয়ারার ১০টি, কুলের ৩টি, লেবুর ৪টি, জাম্বুরার ৫টি, লিচুর ৪টি, তেঁতুুলর ১টি, কামরাঙা ৩টি, জলপাই, লটকন, আমলকী, মালটা, অরবরই, স্ট্রবেরি, কদবেল, কাঁঠাল, আমড়া, ও কাজুবাদাম এর ১টি করে জাত, জামরুলের ৩টি ও সফেদার ৩টি জাত।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের অর্থায়নে ইন্টার কোঅপারেশন এগ্রো ফরেস্ট্রি ইমপ্রুভমেন্ট পার্টনারশিপের ব্যবস্থাপনায় এ ফল সেন্টারটির গোড়াপত্তন হয় ১৯৯১ সালে। তখন প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ফ্রুট ট্রি স্টাডিজ, পরবর্তীকালে এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয়, ফলগাছ উন্নয়ন প্রকল্প, এখন এটাকে ফলদ বৃক্ষের জার্মপ্লাজম সেন্টার বলা হয়। ১৯৯১ সালে প্রকল্পটি মাত্র এক একর জায়গা নিয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে কর্মমুখর হয়ে ওঠে, যার ফলাফল ক্রমেই ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। বর্তমানে এর আয়তন ৩২ একর। বনবাদাড়, পাহাড় পর্বত চষে বেড়ান এ প্রকল্পের কর্মীরা। শুরু হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দেশের প্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় ফলের গাছ সংগ্রহ। দেশীয় আবহাওয়ায় উপযোগী ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ফলের জাত উদ্ভাবনে ব্রত হন।
ময়মনসিংহ শহরের দক্ষিণে আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এ প্রকল্পের অবস্থান। ৩২ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সেন্টারটি। এ সেন্টারটিতে রয়েছে ১৮১ প্রজাতির প্রায় ১৩ হাজার দেশি-বিদেশি বিরল ফলের মাতৃগাছ। এর মধ্যে ৩০১ রকমের আম, ৫৭ রকমের পেয়ারা, ২৩ রকমের লিচু, ৮৭ রকমের লেবু, ৯৪ রকমের কাঁঠাল, ৬৭ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় অপ্রধান ফল, ৬৮ প্রজাতির ফলদ ঔষধি গাছ। ৩২ একর রাজ্যে পুরোটা জুড়ে শুধু গাছ আর ফল, স্বপ্নমাখা সবুজের মধ্যে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। মূল ফটক থেকে সেন্টারের ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখতে পাবেন রাস্তার দুই সারিতে বিভিন্ন রকমের জামরুল, জলপাই আর পেয়ারার সারি, রাস্তা ধরে ভেতরে প্রবেশ করলে ডান দিকে চোখে পড়বে আমের রাজ্য। এখানে খুব ছোট ছোট গাছে রঙ-বেরঙের ফুলফলে সাজানো গাছের দিকে তাকালে মন ভরে যাবে। একটু সামনে গেলে একটি সাদা রঙের ভবন চোখে পড়বে। এটাই এই সেন্টারের অফিস। এখান থেকেই সব কিছু মনিটরিং করা হয়। অফিস রুমের সামনে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়বে বিভিন্ন প্রজাতির ফল। যার কোনোটি টবে, কোনোটি অর্ধড্রামে আবার কোনোটি মাটিতে পোঁতা। জ্যৈষ্ঠ মাসে এ বামন গাছগুলোতে ঝুলে থাকে অসংখ্য কাঁচা-পাকা আম। ভবনের উত্তর পাশে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির লেবু-পেয়ারা ও বারোমাসি আমড়া। বর্তমান সময়ে এ দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাউকুল, আপেল কুল, তাইওয়ান কুল, ঢাকা-৯০, নারিকেলি কুল, বারিকুল, নাবিকুল, হাজারীকুল, চাইনিজ কুলসহ অনেক দেশিকুল। আর পেয়ারা? বিচিত্র তার আকার, পাতা ও স্বাদ। কোনোটি মিষ্টি, কোনোটি টক, কোনোটি মচমচে আবার কোনোটি রঙিন, লাল শাঁস, সাদা শাঁস কোনোটিই বাদ যায়নি। বাগানে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আদা লেবু, কাটা লেবু, শাঁসনি লেবু, সাতকড়া, দার্জিলিং, ভ্যালেন্সিয়া, মনিপুরী এবং মোসাম্বি কমলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির লেবু। আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন আকারের এবং স্বাদের বাতাবিলেবু তো আছেই।
অফিসের ঠিক পূর্ব দিকে রয়েছে এ দেশের বিলুপ্তপ্রায় অপ্রধান ফল, সবুজপাতা ছাপিয়ে থোকায় ঝুলছে বেঁটে সফেদা, কালোপাতি সফেদা, বাদামি সফেদা, লাল টকটকে আপেল জামরুল, গোলাপি রঙের নাশপাতি জামরুল, সবুজ জামরুল, বামন জলপাই, মিষ্টি ও হাইব্রিড কামরাঙা, বৈচি, লুকলুকি, পানিয়ালা, খিরনি, হরীতকী, বহেড়া, বন কাঁঠাল, ফলসা, স্টার আপেল, লোকাট, চেরি, করমচা, অরবরই, মহুয়া, আমলকী, বেল, কিন্তু অনেকেই চিনি না লুকলুকি, ডেউয়া, ডেফল, করমচা, জঙ্গিবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, পানিজাম, কালোজাম, তুঁত, তিনকরা, তাবা, ত্রিপত্রিক লেবু, জামির, মনফল, আঁশফল, তারকা ফল, দেশি গাব, বিলাতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈকর, গুটি জাম, খেজুর, জাম, জামরুল, চেস্টনাট, তরমুজ ডালিম, টক লেবু, চালতা, ডুমুর, টক আতা, তেঁতুল, পানি ফল, সিঙ্গাড়া ফল, দেশি আমড়া, বন্য ডুমুর, বাঙি, চাপালিশ, জিলাপি ফল, পদ্মফল, মাখনা, রুটি ফল, বকুল, ফলসা, ট্যাংফল, চুকুর, রাম কলা, কেন ফল, চিনার, রক্ত গোটা, চিকান, পানকি, চুনকি, টুকটুকি বা টাকিটাকি, আমরুল, পেয়ালাগোটা, চিনাডুলি, লতা ডুমুর, বুদুমচোরা, টমিটমি, কোয়াগোলা, গুটগুটি, বিলিম্বি, কেক ফল, অমৃত ফল, চাউর, আলুবোখড়া, চেরি, খিরনি, বকুল, মহুয়া ও আঁশ ফল যা হাজার বছরেরর ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে । এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছ, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। অথচ পুষ্টিগুণ এবং ভেষজ মূল্য একেক ফলে এক এক রকম। অথচ এক রকম অবহেলা করেই আমরা আমাদের এসব ফলকে হারাতে বসেছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনও অল্প স্বল্প হলেও এর অনেক ফলই দেশের মাটিতে টিকে আছে। এ ফলগুলো বিদেশি ফলের আগ্রাসনে এবং উদ্ভাবিত নতুন জাতের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছিল। বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার উপরোল্লিখিত বিলুপ্তপ্রায় সব ফলগুলো বন, জঙ্গল, পাহাড়, বসতভিটাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে এবং এর ওপর নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জার্মপ্লাজম সেন্টার এ সব দেশীয় ফলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে। বর্তমানে এ জার্মপ্লাজম সেন্টারটি বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ ফলদ বৃক্ষের সংগ্রহশালা। এ যেন এক জীবন্ত ফলের জাদুঘর। সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা প্রকৃতির কন্যার অলংকার এ জার্মপ্লাজম সেন্টারটি। এটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অহংকার। অহংকার এ দেশের মানুষের। বেঁচে থাক এ সেন্টারটি । এগিয়ে যাক দুর্বার গতিতে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)
দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) । এ পর্যন্ত এ ইনস্টিটিউট থেকে আমের ১১টি, কাঁঠালের ৩টি, পেয়ারার ২টি, বাতাবিলেবুর ৩টি, লেবুর ৩টি, আমলকির ১টি, বিলাতিগাবের ১টি, সফেদার ১টি, কুলের ৪টি, আঁশ ফলের ১টি, কামরাঙ্গার ১টি, তেঁতুলের ১টি, লিচুর ৫টি, জামরুলের ২টি, মিষ্টিলেবুর ১টি, জলপাইয়ের ১টি ও কদবেলের ১টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ফলগুলোকে কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদের জন্য সম্প্রসারিত করা হয়েছে। অনেক ফলের জাত ভালো জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুরে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন হিসেবে দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য এ ইনস্টিটিউট জৈন্তাপুরে লেবুজাতীয় ফসল, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণা কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে যেমন- জামালপুর, ঈশ্বরদী, খয়েরতলা (যশোর), হাটহাজারী (চট্টগ্রাম), রহমতপুর (বরিশাল), আকবরপুর (মৌলভীবাজার) ও বুড়িহাট ফার্ম (রংপুর) আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। এ আঞ্চলিক ইনস্টিটিউটগুলোতে নিবিড় গবেষণাসহ দেশীয় ফলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা (বিনা) পরমাণু শক্তিকে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, অচিরেই এ ইনস্টিটিউট থেকে ভালো কিছু দেশি ফলের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে। এ ইনস্টিটিউট অবশ্য অনেক দেশি ফলের জাত সংরক্ষণও করছে।
ড. মো. শামছুল আলম মিঠু**
*পরিচালক, **সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ